ইমিগ্রান্ট কড়চা (মাতৃভাষা),আসমা খান, Immigrant Diary (Mother Language), Asma Khan, Ottawa
’৭৮ সালে আমার স্বামি বিলেত বৃত্তি নিয়ে গিয়েছিলেন তিনটি অক্ষর অর্জনের জন্য। অক্ষর তিনটি হচ্ছে Ph.D. একজন সফল রেস্টুরেন্ট ব্যাবসায়ী নিজের মেয়েরা বড় হয়ে গেছে বিয়ে দেয়ার জন্য বিলেত থেকে সপরিবারে বাংলাদেশে যাবার আগে তার সেমিডিটাচড বাসাটা আমাদের কাছে ভাড়া দিয়ে গিয়েছিলেন। পুরো পাড়ায় আমরা কয়েক ঘর মাত্র বাদামী (এশিয়ান) পরিবার ছিলাম। মনে কষ্টের আঁচর লাগত যখন বিদেশীরা আমাদের Pakis ডাকত, আর পাকিস্তানিরা জিজ্ঞেস করতো উর্দু জানিনা কেন। এ ধরনের এক পরিস্থিতিতে বেশ রাগ করেই আমি সেই পাকিস্তানীকে পালটা জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘তুমি কি বাংলা জানো?’ তিনি একটু চুপ থেকে, তারপর শান্ত স্বরেই বলেছিলেন ‘উর্দু কিন্ত পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই মাতৃভাষা নয়, পশতু, বেলুচী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি পশ্চিম পাকিস্তানে একেক প্রদেশে একেক মাতৃ ভাষা, তোমাদের বাংলার মত। কিন্ত স্কুলে আমরা উর্দু শিখেছি সার্বজনীন বা সাধারন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে’। আমাদের মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন আসলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে কুৎসিত অর্থনৈতিক বৈষম্যর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রথম বর্হিপ্রকাশ।
ঢাকার তেজগাও এয়ারপোর্ট থেকে যখন প্রথম উড়াল দিয়েছিলাম বিদেশে, তখন দেশটি ছিল একটি সদ্য স্বাধীন শিশু রাষ্ট্র, যুদ্ধের ক্ষত বড় দগদগে, দৃষ্টিকটু, অগুনতি মানুষ মৃত, নিখোঁজ, রাস্তা ঘাট ভাঙ্গাচোড়া, দারিদ্র, অনিয়ম আর বিশৃংখলার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। বিদেশে না গেলে দেশের প্রতি মায়া মমতার গভীরতা বোঝা যায় না। সেই প্রথম দেশের জন্য, স্বজনের জন্য, ভাঙাচোরা রাস্তার জন্য, বান্ধবীদের জন্য, রিকসার জন্য, ঝালমুড়ি, ফুচকা, ঘুগনি, শিঙ্গাড়ার জন্য, সবচেয়ে বড় কথা মা বাবা ভাই বোনের জন্য মনটা একেবারে নরম হয়ে থাকতো। বাংলায় কথা বলার জন্য মন হু হু করতো।
১৫ ই নভেম্বর ’১৭ সাল। অটোয়ার সিটি হলে ‘বাংলা ক্যারাভান’ এর আমন্ত্রনে স্মরণযোগ্য অনুষ্ঠানে গিয়ে গৌরব অনুভব করেছি। ইউনেস্কো স্বীকৃত ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবশ’কে অটোয়ার মেয়র জিম ওয়াটসন ২১ শে ফেব্রুয়ারী ’১৮ সালে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবশ’ উদযাপনে অনুমোদন দিলেন। মনে পড়লো ’০২ সালে Bayshore recreation center এ আমরা MCSO নামে নিমন্ধিত সমিতির প্লাটফর্মে ‘২১ সে ফেব্রুয়ারী’ পালন করেছিলাম। অনুষ্ঠানে আমাকে মুগ্ধ, বিষ্মিত করেছিল এক কিশোরী, তার নির্ভূল উচ্চারণে বিশাল কবিতাটি আবৃতি করে, ‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে/দয়া হীন সংসারে… …’। সেই কিশোরী নাম নরিন, এখন পড়াশোনা শেষ করে, বিয়ে করে, চাকরি নিয়ে সফল ব্যাক্তিত্ব। সিটি হলে সে তার সঙ্গী সহ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করলো।
বিশ্বায়নের যুগে ভাষা হচ্ছে মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ, প্রকাশ, পরিচয়ের মাধ্যম। শিশু জন্মের পর তার মায়ের সাথে যোগাযোগের প্রকাশ শুধু কান্না, একমাত্র মা ই বুঝতে পারে কোনটা ক্ষিদের কান্না, কোনটা ঘুমের কান্না, কোনটা ডাইপার চেঞ্জের কান্না। অনুভুতি, অভিজ্ঞতা, ভালোবাসায় মা সন্তানকে এমন ভাবে বুঝতে পারেন সমস্ত পৃথিবী্র দুর্যোগে্র অস্পস্টতায় কেউ না বুঝলেও মা সন্তানের প্রয়োজন বুঝতে পারেন। ক্রমশঃ শিশুর কান্না শব্দ হয়, যোগাযোগের ভাষা হয়। আরো বড় হলে সে শিখতে পারে ভাষার লিখিত রূপের সাথে, ‘অক্ষর’ নামক সাংকেতিক চিহ্নের সাথে। মায়ের সাথে সন্তানের সহজ ও বোধগম্য সম্পর্ক প্রতিফলনে যে শিল্প রূপ শব্দে ও অক্ষরে মলাট বন্দি হয় সেটাই মাতৃ ভাষা।
প্রত্যেক জাতীর কিছু ঘটনা কিছু ব্যাক্তির নিঃস্বার্থ ত্যাগ স্বীকার জাতীকে ইতিহাসের উচ্চতর সোপানে গৌরবের মুকুট পড়ায়। এজন্য সে ত্যাগ স্বীকার জাতীয় জীবনে আগামী প্রযন্মের জন্য তা উজ্জ্বল মাইল ফলক। ’৫২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে, তদানিন্তন পুর্ব পাকিস্তানে যে ভাষা সৈনিকরা মাতৃ ভাষা বাংলার জন্য জীবন দিয়েছিলেন, তাঁরা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। জীবনতো নশ্বর, সফলতা বা বিফলতার কথা চিন্তা না করে সময়ের দাবী, জীবনের প্রয়োজনের দাবীকে সামনে রেখে যে ভাষা সৈনিকেরা জীবনকে বাজী রেখে ছিলেন, তাঁরা ত্যাগের যাদুতে বিশ্বব্যাপী আমাদের স্বীকৃতি ও পরিচিত করে গেলেন। আমরা তাঁদের কাছে অশেষ ঋণে ঋণী।
সে ঋণ স্বীকারে আমরা আমাদের দ্বিতীয় প্রযন্মকে বাংলা শেখানোতে উদ্যগী হয়েছি, অটোয়াতে এখন কয়েকটি বাংলা স্কুল চলছে। ‘০৯ সালে SNMC এর উদ্যোগে অনেক প্রতিকুলতা অতিক্রম করে আমরা বারহেভেনে বাংলা স্কুল শুরু করেছিলাম, সাফল্যর সাথে যা আজও চলছে। অনুবাদে, বিশ্ব সাহিত্য থেকে বাংলায়, বাংলা থেকে অন্য ভাষায় আমাদের দ্বিতীয় প্রযন্ম অনায়াসে নেতৃত্ব দিতে পারে, লেখকদের নিয়ে সেমিনার করতে পারে, শিল্পের অন্যান্য শাখায়ও সমৃদ্ধ করতে পারে। শুধু একটা জিনিস বুঝতে হবে, যে কোন ঘটনা ‘ক্যামেরার চোখে’ নয়, ‘মায়ের চোখে’ প্রজ্ঞার আলোয় দেখলে, ‘কম্পিউটারের ভাষায়’ নয় ‘মায়ের ভাষায়’ অর্থাৎ মমত্বের ভাষায় লিখলে অনায়াসে ‘ধরা গ্রামের’ যে কোন শহরেই সগৌরবে বিকশিত হতে পারবে বাংলাদেশীরা।