Immigrant Diary ( Happy New year 2018) ইমিগ্রান্ট কড়চা , আসমা খান
বেশ ছোট ছিলাম। কিন্ত স্মৃতিটা এত উজ্জ্বল যে মনকে উসকে দেয়ার জন্য স্মরন করি এখনও। দৃশ্যটা ছিল সূর্য্যাস্ত আর সূর্যাদয়ের। খুলনা থেকে নদীপথে রকেটে করে নারায়নগঞ্জে যাবার পথে বিশাল থৈ থৈ নদীর উপর আকাশ তার অদৃশ্য কোন চিত্রকরের তুলির আঁচরে রঙ্গিন, অপুর্ব সুন্দর, এবং দিগন্তে যে্খানে নদী ও আকাশ এক রেখায় একাকার, সোনার থালার মত সুর্য্যটা যখন ঝুপ করে ডুবে গিয়েছিল! সেটা ছিল বছর শেষের সূর্য্যাস্ত এবং একই ভাবে প্রদোষের আলোয় মৃদু ঢেউ এর নদী থেকে দিগন্তে নুতন বছরের সূর্যোদয়! অদ্ভুত সুন্দর!! আমদের ভ্রমন সঙ্গী ছিলেন মামা, সেদিকে তাকিয়ে অভিভুতের মত বলেছিলেনঃ ‘যায় দিন ভালো যায়, ও আল্লাহ আসে দিন ভালো রাখো’।
তার ঢের পরে চমকে উঠেছিল মহিলা কলেজ! নুতন বছরে জানুয়ারীতে খোলার পর পর। মেয়েরা নোটিশ বোর্ডের সামনে হুমড়ি খেয়ে হামলে পড়ছিল। সেই প্রথম কে বা কারা যেন মহিলা কলেজে নববর্ষের ‘খেতাব’ দিয়ে একেবারে হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছিল। তখনকার সেই রক্ষনশীল সময়ে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মণ্ডলী ও বাদ যায়নি সে সমস্ত রীতিমত আপত্তি কর খেতাব থেকে। ‘ডুবে ডুবে জল খাওয়া’, বা ‘ছ্যাক খাওয়া মহাপুরুষ’, ইত্যাদি খেতাবে খুব হৈ চৈ হলেও সেই বেনামী অপরাধী কিন্ত ধরা পড়েনি। ব্যাচের সবচেয়ে প্রানবন্ত কাঁচ ভাঙ্গা উচ্ছল হাসিতে কলেজ মাতিয়ে রাখা মেয়েটি হটাৎ করেই বেনারসি শারিতে কনে সেজে সুদুর কানাডার মন্ট্রিয়েলে পাড়ি দিয়েছিল। প্রায় তিন যুগ পরে তার সাথে দেখা! স্মৃতিচারনের পয়লা ঘটনা সেই নববর্ষের ‘খেতাব’, আর ঐ দুষ্টু ঠিক সেই আগের মত বাঁধভাঙ্গা হাসিতে বলে ‘আমি খেতাব দিয়ে বাসায় বসে সব খবর রাখছি রে, কেউ ধরতে পারে নাই! আরে শুন ছ্যাক খাওয়া মহাপুরুষ নাকি কইছিল, ‘আরে না আমি হচ্ছি ছ্যাঁক দেয়া মহাপুরুষ’, আচ্ছা ক’ মেয়েরা এত কি বোকা?’… …
বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণের জৌলুস, প্রতিশ্রুতি বা প্রতিজ্ঞার সাথে আমরা পুবের মানুষ, আমাদের এত দহরম মহরম ছিল না। আমার কাজ পাগোল স্বামীর কাছে প্রতিদিনই একটি নুতন দিন, সেদিনে কি কি কাজ করতে হবে তার সময় পঞ্জি। তো সম্রাট বুশ যখন আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছিলেন নাইন ইলেভেনের পর, তখন হটাৎ করেই আমি এক খতরনাক অসুখে পরেছিলাম। সে বছরের ডিসেম্বরের শেষে যখন পাঁচ ঘন্টা অপারেশনের জন্য ডেট দিয়েছিল, নিজের ছোট ছেলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল সেটা বুঝি মৃত্যুদণ্ড। ডিসেম্বরে সারাদেশের মত হাস্পাতালও বড় চমৎকার উৎসবের সাজে সাজানো, অসুস্থ হলেও হেঁটেই গাড়ি থেকে হাস্পাতালে ঢুকেছিলাম। সপ্তাহ খানিক পরে হুইল চেয়ারে সেই আমি যখন বাসায় ফিরে এসেছিলাম মনে মনেই বর্ষ বিদায় আর বর্ষ বরণের অর্জন, বিসর্জন, প্রাপ্তির, সক্ষমতা আর অক্ষমতার ব্যালান্সশীটে প্রতিজ্ঞাটা বড় মুখ্য ভুমিকায় ছিল। এই অসুস্থ জীবনে স্রষ্টার উপর বিশ্বাস, এদেশের স্বাস্থ্য সেবাঃ বিশেষজ্ঞ, ডাক্তার, নার্স, ফার্মাসিস্টের আন্তরিক সেবা, পরামর্শ, একের পর এক বাধা অতিক্রম করিয়েছে।
’০৭ সালের নববর্ষে মেজ মেয়ে তার কাজের সুবাধে উচ্ছাসিত আগ্রহে চেয়েছিল খোদ টাইম স্কোয়ারের কোন হোটেলে রেখে আমেরিকান ‘নিউ ইয়ার্স সেলিব্রেশন’ দেখাতে। তাকে যত বোঝাই আমার পক্ষে ঐ সময়ে বাড়ি ছাড়া মোট্টেও সম্ভব না, সে তত নাছোরবান্দা, শেষমেশ একটু রেগেই বলি ‘মা শুধু তুই ই কি আমার একমাত্র মেয়ে?’ একদম চুপ থেকে খানিক পরে আশাহত উত্তর দেয়, ‘আপনি কিন্ত আমার একমাত্র মা!’… …
কানাডাতে পা ফেলা ইস্তক দেখছি বাংগালীরা যখন তখন সমিতি করে কমিটি করে, দাওয়াত খায়, খাওয়ায় আর দেশের রাজনীতির স্থানীয় নেতা বানায় তর্ক কাজিয়া করে। আর আমার স্বামী, ডক্টর ইমদাদ খান (সিস্টেম ইঞ্জনীয়ার নরটেল, এরিক্সন) স্বেচ্ছাশ্রমে কানাডিয়ান রেজিস্টার্ড চ্যারিটি খুলেছিলেন। মেধাবী, প্রাজ্ঞ, অফুরন্ত প্রেরনার উৎস, কাজ পাগোল, মনে প্রানে বিশ্বাস করেন সমাজে ভালো মন্দ পাশাপাশি ছিল সৃষ্টির শুরু থেকে্ই, সবাইকে নিয়েই সমাজে এগুতে হয়। আর আমি? আমার মায়ের মত স্বপ্নের ফেরীওয়ালা। অফুরন্ত কর্মোদ্যম স্বামীর বিপরীতে বড় অসুস্থ, বড় সীমিত কর্ম ক্ষমতার কারনে স্ট্রেটেজিক হতে হয়েছে। স্বপ্ন ফেরী করতে হলে ধৈর্য্য ধরতে হয়, আশা করতে হয়, আল্লাহর উপর ভরষা করতে হয়। আর কঠোর পরিশ্রমে সমাজে পারস্পারিক বিশ্বাসের প্লাটফর্ম গড়তে হয়।
ইমিগ্রান্টদের দেশ কানাডা। কমন স্পেসে স্বেচ্ছাশ্রমে মানুষ একে অপরকে চেনে। বৃক্ষের পরিচয় যেমন ফলে, মানুষের পরিচয় তার কাজে, আচরনে। প্রতিবছর রাজপ্রতিনীধি গন বিভিন্ন পদক দিয়ে, পুরস্কার দিয়ে স্বেচ্ছাশ্র্মে সমাজে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য সন্মানিত করেন। এবছর SNMC এর পাঁচজনকে এবং নয়জন তরুণ/ তরুণীকে কানাডা ১৫০ বছর উপলক্ষে নিপীনের এম পি মাননীয় চন্দ্রা আরীয়া স্বর্ন পদক দিয়ে স্বীকৃতি দিয়ে সন্মানিত করলেন। স্বদেশ থেকে সেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, বা অনুন্যপায় হয়ে যে সব মানুষ কানাডাতে এসে প্রায় অচেনা আগুন্তুক যখন পরস্পর একান্ত বন্ধু বা পড়শি হিসেবে সমাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে, তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়ে যে উদাহরন স্থাপন করলেন এম পি চন্দ্রা, নীপিনবাসীর পক্ষ থেকে তাঁকে জানাই অজস্র ধন্যবাদ।
নববর্ষে সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।